ভুলে যাওয়া মানেই কি আলঝেইমার্স?

0
108
mental health

আলঝেইমার্স একটি নিউরোলজিক্যাল রোগ। এই রোগে মস্তিষ্কের কোষে এক ধরনের কেমিক্যাল জমা হয়। এতে কোষটি মারা যায়। দেখা দেয় স্মৃতিক্ষয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কথা বলার সমস্যা, মানসিক সমস্যা। স্বাভাবিক জীবনযাপন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।

ভুলে যাওয়া মানেই কি আলঝেইমার্স?

অনেকে মনে করেন, ভুলে যাওয়া রোগ মানেই আলঝেইমার্স রোগ। কিন্তু এটা সত্যি নয়।

ভুলে যাওয়া রোগকে চিকিৎসার ভাষায় বলে ডিমেনশিয়া। বাংলায় বলা যায় স্মৃতিক্ষয় রোগ। অনেক কারণেই ভুলে যাওয়া রোগ হতে পারে। মোটাদাগে এই কারণগুলো দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
ইররিভারসিবল বা অপ্রতিরোধযোগ্য

এ কারণগুলোতে যে ডিমেনশিয়া দেখা দেয়, তা কখনো ঠিক করা যায় না বা এটা দিন দিন বাড়তেই থাকে। খারাপ ধরনের ডিমেনশিয়া এটা। এ ধরনের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাপন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আলঝেইমার্স রোগ কিন্তু এ ভাগেই পড়ে। এটা ছাড়া আরো আছে ফ্রন্ট টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া, ডিমেনশিয়া উইথ লিউ বডি, পারকিনসন্স ডিজিজ ডিমেনশিয়া, মাল্টি ইনফাকর্ট ডিমেনশিয়া, হান্টিংটন ডিজিজ, উইলসন্স ডিজিজ ইত্যাদি।

রিভারসিবল বা চিকিৎসাযোগ্য

মস্তিষ্কের কিছু কারণেও ডিমেনশিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ডিমেনশিয়া চিকিৎসায় উন্নতি হয়। এ কারণগুলোর মধ্যে আছে; যেমন—

♦ মাদক সেবন।

♦ হরমোনের রোগ; যেমন—হাইপোথাইরয়েডিজম, হাইপো বা হাইপার প্যারাথাইরয়েডিজম, অ্যাড্রেনালগ্ল্যান্ড ইনসাফিসিয়েন্সি।

♦ বিভিন্ন অঙ্গ ফেইলিওর; যেমন—কিডনি, লিভার, রেসপিরেটরি ফেইলিওর।

♦ ভিটামিনের অভাব; যেমন—ভিটামিন-বি১২, নিকোটিনিক এসিড, ভিটামিন-বি১।

♦ মস্তিষ্কের টিউমার।

♦ মস্তিষ্কের ক্রনিক ইনফেকশন-এইচআইভি, নিউরোসিসিলিস।

♦ মস্তিষ্কের আঘাত।

♦ নরমাল প্রেসার হাইড্রোকেফালাস।

♦ মানসিক কারণ—অবসাদ, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি।

সাধারণত ৬০ বছরের বেশি বয়স্করা ডিমেনশিয়ায় বেশি ভোগেন। বয়স বাড়লে আক্রান্তের ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেখা গেছে, ৮৫ বছরের বেশি বয়সীদের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। আলঝেইমার্স ডিজিজ নামে রোগটি ডিমেনশিয়ার ৭০-৮০ ভাগ দায়ী। ডিমেনশিয়ার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জায়গা নিয়ে আছে এটা।

পরিসংখ্যান

বিশ্বব্যাপী ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কিন্তু অনেক। প্রায় ৫০ মিলিয়ন লোক ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। ডিমেনশিয়া নিয়ে বাংলাদেশে ২০১৯ সালের আগে জাতীয় পর্যায়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। তবে সম্প্রতি জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (নিনস) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বা ব্যাপকতা ৮.১ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে যা ১১ লাখ। সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী ২০৪১ সালে দেশে এই রোগীর সংখ্যা হবে প্রায় ২৪ লাখ। অর্থাৎ বর্তমান সংখ্যার চেয়েও প্রায় তিন গুণ বেশি। কাজেই আমাদের দেশেও কিন্তু ডিমেনশিয়ার অনেক রোগী আছেন। পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি ৬৮ সেকেন্ডে একজন আক্রান্ত হন আলঝেইমার্স রোগে।

শুরুতে কি আলঝেইমার্স চেনা যায়?

আলঝেইমার্স রোগের শুরু হয় ভুলে যাওয়া নিয়ে। স্মৃতিকে আমরা মূলত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। শর্ট টার্ম মেমোরি ও লং টার্ম মেমোরি। সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছি, এটা মনে রাখতে পারা শর্ট টার্ম মেমোরি। আর কোন স্কুলে পড়েছি, কবে এসএসসি পাস করেছি, এটা লং টার্ম মেমোরি। বেশির ভাগ আলঝেইমার্স রোগ শুরু হয় শর্ট টার্ম মেমোরি সমস্যা দিয়ে। যেমন—মোবাইল কোথায় রেখেছেন, তা খুঁজে না পাওয়া, সকালের নাশতা কী খেয়েছেন, তা মনে করতে না পারা, হিসাব ভুল করা। মাঝেমধ্যে রাস্তা ভুলে যাওয়ার সমস্যাও হতে পারে। অনেকেই নিজের এ সমস্যা মেনে নিতে পারেন না। পরিবারের অন্যদের চোখে অস্বাভাবিক লাগলেও আক্রান্ত ব্যক্তির চোখে এটা স্বাভাবিক মনে হয়। শতকরা ২০ ভাগ রোগীর স্মৃতির কোনো সমস্যা থাকে না। কথা বলতে গেলে তাঁরা শব্দ খুঁজে পান না। এ কারণে তাঁরা কথা দ্রুত বলতে গেলে গুছিয়ে বলতে পারেন না। একই কথা পুনরাবৃত্তি করতে পারেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। দেখা দেয় নানা রকম উপসর্গ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কথা বলার সমস্যা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা। তবে লোকের সঙ্গে সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারেন শুরুতে। শুরুতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায় না তাঁদের সমস্যা আছে। সঙ্গে থাকে আচরণগত সমস্যা। শুরুতে খুব পরিচিত জায়গা ভুলে যান। স্টাইলিশ কেউ হঠাৎ করে ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরা শুরু করেন। যিনি সব সময় চুল পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতেন, তাঁর চুল থাকে উষ্কখুষ্ক। মুড খুব দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। নিজের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন থাকেন। কথা বলার সমস্যা এসে যুক্ত হতে থাকে। কথা বুঝতে পারেন কম। কথা বলেন কম। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের সমস্যা বুঝতে পারেন। তাই তিনি দুশ্চিন্তা করেন। পরিচিত কাউকে চিনতে না পারার কারণে লজ্জিত হন। ডিপ্রেশন তাঁকে ঘিরে ধরে, কিন্তু পরে তিনি বেশ অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যান। যে কাউকে মারধর করতে চান। তাঁর মধ্যে নানা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তিনি পরিচিতদের অপছন্দ করেন, মনে করেন তাঁরা তাঁকে মেরে ফেলবেন। যে জীবনসঙ্গীকে ভালোবেসেছেন নিজের থেকেও বেশি, শেষ বয়সে এসে তাঁকে সন্দেহ করা শুরু করেন। রোগ বাড়তে থাকলে যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করেন। খাবার গিলতেও ভুলে যান। এক লোকমা খাবার নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন। এভাবেই একসময় মৃত্যুমুখে পতিত হন।

পরিবারে কেউ আক্রান্ত হলে কি ঝুঁকি বাড়ে?

সাধারণত বয়স বেশি হলে আলঝেইমার্স রোগের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, আলঝেইমার্স বংশগতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কম বয়স, বিশেষ করে ৫০ বছরের কমে এ রোগে আক্রান্ত হলে সন্দেহ করা হয় জেনেটিক মিউটেশনের কারণে এ রোগ দেখা দিয়েছে। এমনটি হলে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। পরিবারের কেউ আলঝেইমার্স রোগে আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। নারীদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি। ডায়াবেটিস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে তিন গুণ। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, রক্তে হোমসিস্টিন বেশি, মদ্যপান করলে এবং ফলমূল, শাক-সবজি কম খেলে ঝুঁকি বাড়ে।

কম বয়সে ভুলে যাই, আমি কি আলঝেইমার্সে আক্রান্ত?

আমরা ভুলে গেলেই মনে করি রোগ হয়েছে। কিছু জিনিস ভুলে যেতেই পারি, এটা স্বাভাবিক। আবার বয়স বেশি হলে ভুলে যাওয়া বাড়ে, এটাও স্বাভাবিক। ডিমেনশিয়া তখনই বলে যখন ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রভাব ফেলে। ভুলে যাওয়ার জন্য দৈনন্দিন কাজে বিঘ্ন ঘটে। কম বয়সে ভুলে যাওয়ার রোগ হচ্ছে মানসিক চাপ বা অবসাদ অন্যতম। এ ছাড়া চিকিৎসা করা যায় এমন কিছু রোগেও হতে পারে। তাই দেরি না করে দ্রুত নিউরোলজিস্টের পরামর্শ নিন।

রোগ নির্ণয়

এ রোগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় শুরুতে যে চিকিৎসাযোগ্য কারণে ডিমেনশিয়া হয়, তা খুঁজে বের করার জন্য। ডিমেনশিয়ার মাত্রা বের করার জন্য মেন্টাল স্টেট পরীক্ষা করা হয়। নিউরোলজিস্টে পরীক্ষা করবেন। ডিমেনশিয়ার সব রোগীর নিউরোইমেজিং; যেমন—সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করতে হবে। এ ছাড়া রক্ত, হরমোনসহ নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। পেট সিটিস্ক্যানে রোগ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে।

চিকিৎসা কি দেশে আছে?

আলঝেইমার্স রোগ নির্মূলের কোনো ওষুধ নেই। এর মানে কি এ রোগের চিকিৎসা নেই? আচ্ছা বলুন তো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কি নির্মূল হয়? হয় না। ওষুধ খেয়ে রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আলঝেইমার্স রোগটিও এমন। ওষুধ সেবনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এ রোগের চিকিৎসা করা হয় চার প্রকার ওষুধের মাধ্যমে। আমাদের দেশে এ রোগের চিকিৎসার সব ওষুধ পাওয়া যায়। নিউরোলজিস্ট রোগটি কতটা মারাত্মক, তা নির্ণয় করে সঠিক ওষুধ শুরু করবেন। শুরুতে কম ডোজের ওষুধ দিতে হয়। এরপর রোগের উন্নতি দেখে ওষুধের ডোজ বাড়াতে হয়। এ রোগের উন্নতি হয় খুব ধীরে। তাই অনেকেই আছেন রোগীর উন্নতি না হলে অস্থির হয়ে যান। একের পর এক চিকিৎসক পরিবর্তন করেন। এতে কিন্তু চিকিৎসা ব্যাহত হয়। ওষুধগুলোর দাম একটু বেশি, তবে তা নাগালের মধ্যেই।

আলঝেইমার্সে আক্রান্ত হলে করণীয়

♦ আলঝেইমার্সে আক্রান্ত হলে সব থেকে প্রথমে নিজেকে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় দেওয়া।

♦ পরিবারের ভালোবাসা, সাহায্য চান। নিজের পছন্দের কাজ করুন, স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখুন।

♦ সময়, স্থান ও ব্যক্তির পরিচয় ভুলে যাওয়া এই রোগে স্বাভাবিক। তাই একটি ডায়েরিতে আপনার দরকারি কাজ, তারিখ, পরিবার, বন্ধুদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখুন।

♦ বই পড়া, খেলাধুলা, ক্রসওয়ার্ড পাজল সলভ করা বা বাদ্যযন্ত্র বাজালে আলঝেইমার্সের সঙ্গে বোঝাপড়া করা সহজ হয়।

♦ সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রাখলে মস্তিষ্ক সচল থাকে, আলঝেইমার্সের সঙ্গে লড়াই সহজ হয়।

♦ মানসিক চাপ ও অবসাদের সঙ্গে ঠিকঠাক মোকাবেলা করতে পারলে পজিটিভ জীবনবোধ তৈরি হবে।

♦ নিজের খাওয়াদাওয়া ও শরীরচর্চার ওপর জোর দিন।

পরিবারে আলঝেইমার্সের রোগী থাকলে করণীয়

♦ আলঝেইমার্সে আক্রান্ত রোগী শিশুর মতো হয়ে যান। তাই তাঁদের শিশুর মতোই টেককেয়ার করতে হবে।

♦ পরিবারে খুব হাসিখুশি পরিবেশ রাখার চেষ্টা করতে হবে।

♦ আলঝেইমার্সে আক্রান্তদের শারীরিকভাবে কর্মক্ষম রাখলে রোগ আস্তে চলা নীতি মেনে চলে। তাই তাঁদের নিয়ে বাইরে হাঁটতে যান।

♦ যাঁদের পরিবারে এ রোগী আছেন বা যাঁরা তাঁদের সেবাযত্ন করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনটি হলে চিকিৎসকের পরার্মশ নিন। নিজেকে সময় দিন।

প্রতিরোধ কি করা যায়?

আলঝেইমার্স রোগের প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই জানতে চান। এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তা হলো : শাক-সবজি, মাছ, বাদাম বেশি করে খেলে এবং শারীরিক পরিশ্রম করলে এ রোগে আক্রান্তের আশঙ্কা কমে। এ ছাড়া ধূমপান, মদ্যপান না করলে ঝুঁকি কমে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখলে প্রতিরোধের সম্ভাবনা থাকে।

লেখক

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু

সহকারী অধ্যাপক
ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স (নিনস)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে