মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট চরম ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য!

0
851

ঢাকার পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) নমুনার ৯২ শতাংশে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও এর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডসমূহের নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এনএইচএফএইচআরআই) এর গবেষকগণ। এই গবেষণায় সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন ও গবেষণা উপদেষ্টা আবু আহাম্মদ শামীম। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের উচিত ডব্লিউএইচও’র সুপারিশ অনুসরণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ‘Assessment of Trans Fat in PHOs in Bangladesh’ শীর্ষক গবেষণা ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এর সহযোগিতায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) সম্মিলিতভাবে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

এসময়, এটিএন বাংলার বার্তা সম্পাদক নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী এবং করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন প্রজ্ঞার ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক প্রকল্পের টিমলিডার মো: হাসান শাহরিয়ার। পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও) বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে অধিক পরিচিত। বাসা বাড়িতে ব্যবহার না হলেও পিএইচও বেকারি ও অন্যান্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবারে ব্যবহৃত হয়। গবেষণার আওতায় ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের খুচরা বিক্রেতাদের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বেকারি এবং রেস্তোরাঁয় খাবার তৈরিতে সচরাচর ব্যবহার হয় এমন চারটি শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডের তালিকা তৈরি করা হয়। এই তালিকার ভিত্তিতে পাইকারি বাজার (হোলসেলার) এবং পিএইচও উৎপাদনকারী কারখানা থেকে ব্র্যান্ডগুলোর মোট ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করে পর্তুগালের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি এর সহায়তায় সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড বা টিএফএ মাত্রা নির্ণয় করা হয়। পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

এছাড়া, একই ব্র্যান্ডের পিএইচও নমুনার মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতির ব্যাপক তারতম্য লক্ষ করা গেছে। যেমন, একটি পিএইচও ব্র্যান্ডের ৭টি নমুনায় ০.৬৯ গ্রাম থেকে শুরু করে ১৪.৫ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে পিএইচও বা ডালডা সাধারণত ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স ও বেকারিপণ্য তৈরি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের খাবারে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট উপাদানের উপস্থিতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকার কারণেই এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।

গবেষকদলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে বাংলাদেশে অনেক পণ্যেই বিপজ্জনক মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট রয়েছে, যা অধিক হারে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের উচিত হবে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাবারে ট্রান্স ফ্যাটি এসিডের সর্বোচ্চ পরিমাণ মোট ফ্যাট বা তেলের ২ শতাংশ (2g/100g) পর্যন্ত সীমিত করে নীতিমালা প্রণয়ন করা।”

অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, “বাংলাদেশে বিরাজমান হৃদরোগজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে অতিদ্রুত পিএইচও’র ট্রান্সফ্যাট এর মাত্রা ২% এ নামিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি এবং এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই বাজারজাত প্রসেসড খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।”

ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধ-কঠিন মারজারিন (semi- solid margarine) বা কঠিন ডালডা বা বনস্পতি উৎপন্ন হয়, এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়। এই শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (dementia) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (cognitive impairment) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

ডব্লিউএইচও’র হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষ সার্বিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ট্রান্সফ্যাটের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে ডব্লিউএইচও ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ থেকে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলকে অগ্রাধিকারকৃত লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানকারী গ্লোবাল হেলথ এডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, “বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসরণ করে ভারত, থাইল্যান্ড, ব্রাজিলসহ অনেক দেশ খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতি করেছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই গবেষণার ফলাফল ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।”

সংবাদ সম্মেলনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে মোড়কজাত খাবারের পুষ্টিতথ্য তালিকায় ট্রান্সফ্যাটের সীমা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, উপকরণ তালিকায় পিএইচও এর মাত্রা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, ফ্রন্ট অব প্যাকেজ লেবেলস বাধ্যতামূলক করা যা খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি নির্দেশ করবে, এবং “ট্রান্সফ্যাট-মুক্ত” বা “স্বল্পমাত্রার ট্রান্সফ্যাট” এজাতীয় স্বাস্থ্যবার্তা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। এধরনের পদক্ষেপে খাদ্যপণ্যের উপাদান সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতাও বৃদ্ধি পায় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

ইত্তেফাক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে