দীর্ঘদিন ধরেই ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সুস্থ কোষকলার কম ক্ষতি সাধন করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকলাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলাই রেডিওথেরাপির প্রধান উদ্দেশ্য। আয়নায়নকারী রেডিয়েশনের শক্তি ক্যান্সার কোষকলা ধ্বংস করে ফেলতে পারে। আর রেডিয়েশনের এই শক্তিকে ব্যবহার করে ক্যান্সার চিকিৎসার যে পদ্ধতি তাকে রেডিওথেরাপি বলা হয়। আয়নায়নকারী রেডিয়েশন জটিল কিছু জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ার দ্বারা ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকলার মধ্যস্থ ডিএনএ-এর বৃদ্ধি রোধ করে বা কোষকলাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে।
ফলে টিউমার সংকুচিত হয়ে পরে অথবা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে ক্যান্সার সংক্রান্ত লক্ষণগুলোর তীব্রতা হ্রাস করে। কেমোথেরাপি বা অন্য কোনো থেরাাপ সাধারণত ক্যান্সার কোষকলা ছাড়া অনেক সুস্থ কোষকলার ক্ষতি সাধন করে সম্পূর্ণ শরীরের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু রেডিওথেরাপি আঞ্চলিক এবং শরীরের যে স্থানে ক্যান্সার অবস্থিত শুধু সেই স্থানেই প্রয়োগ করা হয় বলে আঞ্চলিকভাবে কোষকলার ওপর প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে যদিও আক্রান্ত স্থানের চতুস্পার্শস্থ কোষকলার কিছুটা ক্ষতি সাধিত হতে পারে তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেহেতু শরীর সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত হয় না তাই শরীর অচিরেই কোষকলার এই আঞ্চলিক ক্ষতিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।
রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গভুক্ত হচ্ছে এক্স-রে বা গামারের আকারে নির্গত ফোটনরশ্মি আর অন্যগুলো হচ্ছে প্রোটন বা ইলেকট্রনের মতো অতি ক্ষুদ্র কণা (পার্টিকেল) বা কোনো ভারি আয়ন যেমন; অক্সিজেন, হিলিয়াম বা কার্বন আয় নেররশ্মি। এই রেডিয়েশনগুলো শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে ক্যান্সার আক্রান্ত এবং সুস্থ উভয় ধরনের কোষকলার সঙ্গে বিভিন্নভাবে বিক্রিয়া করে কোষকলাগুলোর ক্ষতি সাধন করে। কোষকলাগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হলো, এরা এই ক্ষতি মেরামত করে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করে।
তবে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকলার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার ক্ষমতা সুস্থ কোষকলার তুলনায় কম থাকে। তাই রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে হিসাব কষে ক্যান্সার কোষকলাকে ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ রেডিয়েশনের শক্তিকে (ডোজ) কয়েকদিন ধরে ভগ্নাংশিক আকারে প্রয়োগ করা হয় যাতে ক্ষতিগ্রস্ত সুস্থ কোষকলাগুলো পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে আর ক্যান্সার কোষকলাগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
বৃহত্তর পরিসরে রেডিওথেরাপি বলতে অভ্যন্তরীণ (ব্যাকিথেরাপি) বহিস্থ (এক্সটারনাল রেডিওথেরাপি) এক্সরে বিমথেরাপি এবং পার্টিকেল থেরাপিকে বোঝানো হয়। প্রয়োগকৃত পদ্ধতি এবং কি ধরনের রেডিয়েশন ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে এই বিভাজন করা হয়েছে। শরীরের অভ্যন্তরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় রেডিয়েশনের উৎসটি বসানো হলে তাকে ব্যাকিথেরাপি আর শরীরের বাহির থেকে বিশেষ ধরনের মেশিনের সাহায্যে দ্রুত গতির রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হলে তাকে এক্সটারনাল রেডিওথেরাপি বলা হয়। এক্সটারনাল রেডিওথেরাপির মধ্যে বর্তমানে এক্সটারনাল বিম এক্সরে রেডিওথেরাপিকে সনাতন পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেশসহ অনেক দেশে এখনো এই পদ্ধতি বেশি প্রচলিত।
ইদানীং ক্যান্সারের রেডিওথেরাপি দ্বারা চিকিৎসার ক্ষেত্রে পার্টিকেল থেরাপি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিশেষ করে প্রোটন থেরাপি এবং কার্বন-আয়ন থেরাপি।
প্রোটন থেরাপির ক্ষেত্রে প্রোটন শরীরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তার শক্তির বড় একটা অংশ পথিমধ্যে চতুস্পার্শ্বস্থ বিভিন্ন কোষকলার সঙ্গে বিক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যয় করে ফেলে। ফলস্বরূপ অনেক সময় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য বস্তুতে প্রদেয় শক্তির পরিমাণ হ্রাস পায়।এক্ষেত্রে প্রোটন শরীরের অভ্যন্তরে ৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দূরত্বে অবস্থিত কোষকলা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে আর তাই এই দূরত্বে অবস্থিত ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এগুলো অধিক কার্যকর হয়। বৃহত্তর এলাকাজুড়ে বিক্রিয়া ঘটায় চতুস্পার্শ¦স্থ সুস্থ কোষকলার অধিক ক্ষতি সাধিত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াজনিত জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
পার্টিকেল বা আয়ন থেরাপির ক্ষেত্রে কণা বা আযনগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো- এরা ‘ব্রাগ কার্ভ’ অনুসরণ করে চলে যার কারণে কোনো বস্তু তথা শরীরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদের শক্তি প্রদানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে পথিমধ্যে খুব কম শক্তি হ্রাস পায় এবং নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব (ভেদন দূরত্ব) বা গভীরতায় পৌঁছে গিয়ে সেখানে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদান করে শোষিত হয়ে যায়। ফলে পথিমধ্যে, চতুস্পার্শ¦স্থ’ বা ভেদন দূরত্বের চাইতে গভীরে অবস্থিত অন্যান্য সুস্থ কোষকলার কম ক্ষতি সাধিত হয়। এ ধরনের কণা ও আয়নগুলো চার্জযুক্ত হওয়ায় এগুলোর গতি আলোর গতির তিন-চতুর্থাংশ পর্যন্ত উচ্চ মাত্রায় ওঠানো সম্ভব হয়।
গতির সঙ্গে শক্তি বা এনার্জির সম্পর্ক হচ্ছে যত বেশি গতি তত বেশি শক্তি বা এনার্জি। অতি দ্রুত গতিসম্পন্ন হওয়ায় কণা বা আয়নগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে আর তাই ক্যান্সার কোষকলা ধ্বংসের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। গতি ও শক্তি ভেদে এগুলো শরীরের বেশ গভীরে এমনকি ৩০ সেন্টিমিটার ভেতরের লক্ষ্য বস্তুকেও সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত করতে সক্ষম হয়। পার্টিকেল বা আয়নের এই বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং ¯œায়ুর সুরক্ষা প্রদান করে ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানের আয়তন এবং আকৃতি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট মাত্রায় নির্ভুলভাবে অধিক শক্তিশালী রেডিয়েশন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। ফলে সুস্থ কোষকলার কম ক্ষতি সাধিত হওয়ায় পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত জটিলতা কম দেখা দেয় এবং সেকেন্ডারি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।
কণা বা আয়নগুলোর জৈবিকভাবে তেজস্ক্রীয় ক্ষমতা প্রোটনের তুলনায় বেশি হওয়ায় আয়নগুলো ক্যান্সার কোষকলা ধ্বংসে অধিক কার্যকর হয় এবং রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তদুপরি যেসব টিউমার সনাতন এক্স-রে রশ্মির প্রতি অসংবেদনশীল থাকে সেসব ক্ষেত্রেও এই পার্টিকেল থেরাপি ব্যবহার করা যায়।
প্রোটন থেরাপির ক্ষেত্রে হাউড্রোজেনের পরমাণু থেকে প্রোটন বের করে এগুলোকে দ্রুত গতি সম্পন্ন করে থেরাপিতে ব্যবহার করা হয়। প্রোটন খুব কম ওজন বিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র চার্জযুক্ত কণা হওয়ায় এগুলোকে সহজে দ্রুত গতিসম্পন্ন করে তোলা যায়, তুলনামূলকভাবে ছোট মেশিনের প্রয়োজন হয় এবং কম প্রযুক্তিগত জটিলতা থাকে। আর আয়ন থেরাপির ক্ষেত্রে ভারি আয়নগুলোকে দ্রুত গতি সম্পন্ন করে তোলা হয়।
ইদানীংকালে প্রোটন থেরাপি এবং আয়ন থেরাপি এই দুই ধরনের মধ্য থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্বন আয়ন থেরাপিকে অধিক সম্ভাব্য থেরাপি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে কার্বন-আয়ন থেরাপির কিছুটা বেশি ইতিবাচক ভৌত ও জৈবিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। এক্স-রে বিমের একক দূরত্বে শক্তির পরিমাণ (এলইটি) কম হওয়ায় সাধারণভাবে এগুলো এক আঘাতে এক পাকবিশিষ্ট (সিঙ্গল স্ট্রান্ডেড) ‘ডিএনএ’কে ভাঙতে পারে; দুই পাকবিশিষ্ট (ডাবল স্ট্রান্ডেড) ‘ডিএনএ’কে ভাঙতে বা ধ্বংস করতে দুবার আঘাত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।
যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত কোষকলাগুলোর এক পাকবিশিষ্ট (সিঙ্গল স্ট্রান্ডেড) ‘ডিএনএ’ পুনরুজ্জীবিত করে তোলার নিজস্ব ক্ষমতা থাকে তাই চিকিৎসা শেষেও এগুলোর মধ্য থেকে কোনো কোনো ‘ডিএনএ’ ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। কার্বন আয়নগুলোর ‘এলইটি’ প্রোটনের তুলনায় বেশি। উচ্চ মাত্রার ‘এলইটি’ হওয়ায় কার্বন আয়নগুলো এক আঘাতেই দুই পাকবিশিষ্ট ‘ডিএনএ’-কে ভেঙে ফেলতে পারে। ফলে ক্যান্সার কোষকলার ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই কার্বন থেরাপির ক্যান্সার বিধ্বংসী ক্ষমতা অন্য থেরাপির তুলনায় কিছুটা বেশি।
প্রোটন থেরাপির তুলনায় আয়ন থেরাপির ক্ষেত্রে চিকিৎসাকে কার্যকর পর্যায়ে উন্নীত করে তুলতে কম সময় লাগে তাই সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা প্রদানের সময়কাল কমে আসে এবং ভগ্নাংশিকভাবে রেডিয়েশন প্রদানের ক্ষেত্রে বিষাক্ততাজনিত সমস্যা কম হতে দেখা যায়। বর্তমানে গড়ে প্রতি রোগীকে ৩ সপ্তাহে ১৩টি ভগ্নাংশে রেডিয়েশন ডোজ প্রদান করা হচ্ছে। এর ফলে আয়ন-থেরাপির মাধ্যমে একই সময়ে অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় অধিকসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়।
আয়নগুলোর ওজন বেশি হওয়ায় পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে কম পরিমাণে বিক্ষিপ্ত হয় এবং যেই টিউমারকে লক্ষ্য করে রেডিয়েশন প্রদান করা হয় অনেকাংশে সেই দিক অনুসরণ করেই চলে। ফলে সুস্থ কোষকলা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উচ্চ মাত্রার ‘এলইটি’ যুক্ত আয়নগুলোর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হলো কম অক্সিজেন বর্ধন অনুপাত (অক্সিজেন এনহেন্সমেন্ট রেশিও), আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষকলার পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা হ্রাস করা, কোষকলার জীবনচক্র সংক্রান্ত প্রভাব হ্রাস করা, ক্যান্সার বিস্তৃত হয়ে পরার সম্ভাবনা হ্রাস করা ইত্যাদি।
প্রোটন বা আয়ন বিম থেরাপি স্থাপনার ক্ষেত্রে সনাতন প্রোটন থেরাপির স্থাপনার তুলনায় উচ্চ মাত্রার প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রোটন বা আয়ন বিমকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় দ্রুত গতিসম্পন্ন তথা শক্তিশালী করে তুলতে বড় মেশিনের প্রয়োজন হয় এবং তুলনামূলকভাবে ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। আয়ন প্রোটনের তুলনায় ভারী হওয়ায় আরও বড় মেশিনের প্রয়োজন হয় এবং ব্যয় আরও বেড়ে যায়।
তাই যদিও প্রোটন এবং আয়ন উভয় ক্ষেত্রেই সনাতন এক্সরে বিম থেরাপির তুলনায় অধিক সুবিধা পাওয়া যায় কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় সাধারণভাবে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিম থেরাপির ক্ষেত্রে প্রোটন না আয়ন কোনটি ব্যবহার করা হবে তা নির্ধারণের জন্য ব্যয়ের সাপেক্ষে চিকিৎসা প্রদান কতটা উপকারী হবে সেই বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
লেখক :
ড. জাকিয়া বেগম
মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট এবং অধ্যাপক ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, বাংলাদেশ