টিকা নিন, স্বাস্থ্যবিধিও মানুন

0
802
Spread the love

সারা দেশের মানুষ এখন বিপুল উৎসাহে কোভিড-১৯ প্রতিরোধক টিকা নিচ্ছেন। প্রথমদিকে মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার বিষয়ে কিছুটা দ্বিধা-সংশয় থাকলেও এখন আর তা নেই বললেই চলে। কারও কারও মনে কিছু দ্বিধা হয়তো আছে; কিন্তু টিকা নেওয়ার জন্য তারাও নিবন্ধন করছেন।

দ্বিধা থাকার কারণ হলো, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সম্পূর্ণ নতুন একটি রোগ; শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে। আর এ রোগের টিকাও একেবারে নতুন। তা নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ প্রাণঘাতী ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ, তারপর দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে এবং প্রাণহানিও ঘটতে থাকে। সরকার করোনা মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। লকডাউন করে সবকিছু বন্ধ রাখা হয় দীর্ঘ সময়ের জন্য।

স্বাস্থ্যবিধিও ঘোষণা করা হয় এবং তা পালনের জন্য কঠোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়। জনগণ এক অভূতপূর্ব অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে পড়ে। এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এখনো রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা এ ভাইরাস প্রতিরোধের টিকা তৈরিতে সচেষ্ট ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের বিজ্ঞানীরা টিকা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এক সময় নতুন এ টিকা উপযুক্ত ও নিরাপদ প্রমাণিত হওয়ায় এটির প্রয়োগ শুরু হয়।

আমাদের সরকার যথাসময়েই টিকা আমদানির উদ্যোগ নেয় এবং ব্রিটেনের অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত টিকা আনার ব্যবস্থা করে। অক্সফোর্ডের এ টিকা উৎপাদিত হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে এবং সেখান থেকেই আমদানি করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে ৫০ লাখ টিকার প্রথম চালান এসেছে এবং সেগুলোর প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া আরও ২০ লাখ টিকা ভারত সরকার পাঠিয়েছে উপহার হিসাবে। এরপরে আরও পাঁচটি চালানে আড়াই কোটি ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে।

অন্য দেশের টিকা না এনে অক্সফোর্ডের টিকা কেন আনা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যাও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। তারা বলেছেন, অন্য দেশের টিকা আনতে অনেক সময় লাগত এবং খরচও অনেক বেশি পড়ত।

এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই অক্সফোর্ডের টিকা আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন যত দ্রুত সম্ভব দেশের সব মানুষের কাছে টিকা পৌঁছে দেওয়াই সরকারের কর্তব্য।

করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম চালান ঢাকায় পৌঁছায় জানুয়ারির শেষার্ধে এবং টিকাদানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২৭ জানুয়ারি। এরপর রাজধানীর পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষামূলকভাবে এক সপ্তাহ টিকা দেওয়া হয়।

একইসঙ্গে টিকা নিতে আগ্রহী ব্যক্তিদের নাম নিবন্ধন শুরু হয় অনলাইনে। ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীসহ সব জেলা-উপজেলায় টিকা প্রদান শুরু হয়। প্রথম দিনে সারা দেশে টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০ জন। দ্বিতীয় দিন থেকেই টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা বড়তে থাকে।

পঞ্চম দিনে অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি দুই লাখের বেশি মানুষ টিকা নেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ লাখের বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন। করোনার টিকা গ্রহণে আগ্রহী মানুষের নিবন্ধন সংখ্যা সোমবার পর্যন্ত ২০ লাখের বেশি এবং তা ক্রমেই বাড়তে থাকবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে।

টিকা নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে-এ আশঙ্কা সবার মধ্যেই ছিল। তবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আগেই বলেছিল, সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে খুব কমসংখ্যক ব্যক্তির দেহে।

বাস্তবেও তাই দেখা গেছে-যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অতি নগণ্যসংখ্যক মানুষের দেহে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। ফলে অন্যান্য মানুষের সাহস ও আগ্রহ বেড়েছে এবং তারা নাম নিবন্ধন ও টিকা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসছেন। টিকাদান কেন্দ্রগুলোয়ও ভিড় বাড়ছে।

করোনার টিকা নেওয়ার পরও কিন্তু সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এ কথা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি-নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।

সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ একজন মানুষ আরেকজন থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরে থাকবেন। করোনা যেহেতু ছোঁয়াচে, সেহেতু এ রোগের ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমিত হতে পারে, আর সে কারণেই এই কঠোর স্বাস্থ্যবিধি।

অনেকে আশা করেছিল, টিকা নিলে এ কঠোর নিয়ম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা যাবে; কিন্তু এখনো সেই সময় আসেনি।

টিকা নেওয়ার পরও কেন স্বাস্থ্যবিধি আগের মতোই থাকবে? এ বিষয়ে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা করোনার ঝুঁকি শতভাগ দূর করবে না।

কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যাবে। টিকা উৎপাদনকারী এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনো টিকাই করোনা প্রতিরোধে শতভাগ নিশ্চয়তা দেয় না।

অতএব, মানবদেহের করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা শতভাগ নিশ্চিত করার জন্যই স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। তবে টিকা নিয়ে লাভ হচ্ছে এই যে, আমাদের দেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে যাবে।

সেই সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা আগের তুলনায় অনেক স্বাভাবিক হবে। এখন আমরা সর্বক্ষণ করোনার আতঙ্কে থাকি, এ আতঙ্ক পুরোপুরি দূর না হলেও বহুলাংশে হ্রাস পাবে। এটাই তো বড় লাভ।

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা এ রোগ প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কার করেছেন এবং তার প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। টিকা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। আশা করা যায়, তারা আরও উন্নত টিকা তৈরি করতে পারবেন, যা শতভাগ কার্যকর হবে।

এখন প্রত্যেককে ৮ সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ডোজ টিকা নিতে হচ্ছে। এরপর এক ডোজের টিকা আসবে, যা সর্বসাধারণের জন্য সহজলভ্য হবে।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববাসী করোনা মহামারির মতো বিপর্যয়ের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। সারা বিশ্বে এ সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১১ কোটি মানুষ, মারা গেছেন ২৪ লাখের বেশি।

গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৪০ হাজারের বেশি, মৃতের সংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

গত এক মাস ধরে দেশে করোনা সংক্রমণ কমে আসছে। তবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে-এ কথা বলা যাবে না। প্রতিদিনই কয়েকশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণহানিও ঘটছে। পশ্চিমের দেশগুলোয়, ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার সংক্রমণ এখনো বাড়ছে।

কিন্তু বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে এ রোগের সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, উন্নতির এ ধারা ধরে রাখতে হলে দেশের সব মানুষকেই টিকা নিতে হবে। সবার জন্য টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে; সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসে।

ইউরোপ ও আমেরিকায় যখন করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, তখন এশিয়ার অনেক দেশে সংক্রমণ কমছে। সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু টিকাদান শুরুর অনেক আগেই সে দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কারণ, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সিঙ্গাপুরে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে কয়েক সপ্তাহ আগেই। জীবনযাত্রা সেখানে স্বাভাবিক, সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি আগের মতোই মেনে চলতে হচ্ছে। ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

করোনাভাইরাসজনিত রোগ নিরাময়ের ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। কাজেই করোনাকে প্রতিরোধ করেই এ রোগ থেকে বাঁচতে হবে। সে জন্য টিকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা জরুরি। এভাবেই আমরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারব।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে