শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয়

0
560
Spread the love

বয়ে চলছে  গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহ ও খরা। যার কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। আর প্রকৃতপক্ষে শিশুরা ডায়রিয়ার ঝুঁকিতে থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই শিশুর সুরক্ষায় ডায়রিয়া সম্পর্কে জানা ও সচেতনতা জরুরি।

ডায়রিয়া
দিনে তিনবার বা তার বেশি তরল পায়খানা যা যেকোনো পাত্রে রাখলে, সেই পাত্রের আকার ধারণ করে; তাই ডায়রিয়া। আবার পায়খানা বার বার হলেও মল যদি পাতলা না হয়, তা ডায়রিয়া নয়। মনে রাখতে হবে, শুধু মায়ের দুধ পান করে এমন শিশু অনেক সময় দিনে পাঁচ-দশবার পর্যন্ত পায়খানা করতে পারে, যা সামান্য তরল হয়, একে ডায়রিয়া বলা যাবে না। শিশু যদি খেলাধুলা করে, হাসিখুশি থাকে, তাহলে এর অন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে  মায়ের সিদ্ধান্তকে ভীষণ গুরুত্ব দিতে হবে।

যদি মায়ের কাছে শিশুর ডায়রিয়া হয়েছে বলে মনে হয়, তাহলে সেই শিশুকে অবশ্যই সঠিক সময়ে শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে।

ডায়রিয়ার প্রকার সমূহ  
১. তীব্র ডায়রিয়া- এটা হঠাৎ শুরু হয়ে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন স্থায়ী হয়। তবে কখনো ১৪ দিনের বেশি নয় এবং পায়খানার সঙ্গে কোনো রক্ত যায় না।
২. দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া- পাতলা পায়খানা ১৪ দিনের বেশি স্থায়ী হলে।
৩. আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি- রক্তমিশ্রিত পায়খানা।

ডায়রিয়ার কারণ
কতগুলো রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করে ডায়রিয়া ঘটায়। এগুলো রোটাভাইরাস, ই-কোলাই, সিগেলা, ভিবরিও কলেরা, প্যারাসাইট-এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা ও জিয়ারডিয়া প্রভৃতি নামে পরিচিত। সাধারণত খাদ্য বা পানীয়ের দ্বারা ডায়রিয়ার জীবাণু মুখে প্রবেশ করে। এর অন্যতম মাধ্যম অপরিষ্কার হাত, গ্লাস, চামচ, বাসনপত্র বা সচরাচর ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র, মল, মাছি ইত্যাদি।

মা বাবার করণীয়
১. যারা বুকের দুধ খায় তাদের বারবার বুকের দুধ দিতে হবে।
২. শিশু যদি বমি করে তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার খাওয়াতে হবে।
৩. ডায়রিয়া ভালো হয়ে গেলেও পরবর্তী ২ সপ্তাহ শিশুকে কম করে হলেও বাড়তি খাবার প্রতিদিন দিতে হবে।
৪. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ শিশুকে খাওয়ানো যাবে না।
৫. ডায়রিয়া এড়াতে হলে পরিবারের সবাইকে ভালোমতো হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
৬. শিশুর ও নিজের নিয়মিত নখ কাটা, প্রতিদিন গোসল, বাচ্চাকে দুধ দেয়ার আগে স্তন পরিষ্কার ইত্যাদি করা।
৭. জন্মের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো। কারণ বুকের দুধ জীবাণুমুক্ত এবং শিশুরোগ প্রতিরোধকারী।
৮. স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করতে হবে এবং বাড়ির ছোট-বড় সবাইকে সেখানে মলত্যাগ করতে হবে।
৯. ছোট শিশুদের পায়খানা বড়দের মতোই রোগ ছড়াতে পারে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। তাই
১০. শিশু পায়খানা করার পরপরই তা তুলে নিয়ে বড়দের বাথরুমে ফেলতে হবে। পায়খানা করার পর শিশুদের পরিষ্কার  করতে হবে অর্থাৎ শিশুর শরীর, পায়খানা করার স্থান এবং নিজের হাত।

শিশুর  খাবার
শিশুকে ঘন ঘন মায়ের দুধ, পানি করান। যদি শিশু শুধুই বুকের দুধ না খায়, তাহলে ওআরএস, সুপারিশকৃত তরল, যেমন- ভাতের মাড়, চিড়ার পানি অথবা নিরাপদ পানি খেতে দিন। ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ৫০-১০০ মিলি এবং ২ বছর বা বেশি বয়সের শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০০-২০০ মিলি খাবার স্যালাইন খেতে দিন। স্বাভাবিক খাবার চালিয়ে যান।  ডায়রিয়া হলে দ্রুত ভালো করে এমন কিছু খাবার হলো-আতপ চালের জাউভাত, কাঁচা কলার তরকারি এবং মুরগীর মাংস। এসব খাবার একত্রে খিচুরি করা যেতে পারে। কিংবা আলাদাভাবে খেতে দেয়া যেতে পারে। এ সময় শাক কিংবা বেশি আশযুক্ত খাবার শিশুকে দেয়া ঠিক নয়। খেয়াল রাখতে হবে তৈরি করা খাবারটি যেন টাটকা এবং জীবাণুমুক্ত হয়। তৈরির পর খাবার যেন সঠিকভাবে ঢেকে রাখা হয়। পচা কিংবা বাসী খাবার একেবারেই খাওয়ানো যাবে না।

শিশুকে কখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিতে হবে
১. শিশু যদি মায়ের দুধ বা পানি পান করতে না পারে।
২. শিশুর অবস্থা যদি খারাপ হয় (অজ্ঞান/নিস্তেজ)
৩. যদি পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়।
৪. ঘণ্টায় তিনবার বা তার বেশি বমি হলে।
৫. পানিশূণ্যতার চিহ্ন দেখা দিলে।

যেভাবে বুঝবেন পানি স্বল্পতা
চোখ বসে যাওয়া, মুখের ভিতর শুকিয়ে যাওয়া, শিশু অস্থির, খিটখিটে, নিস্তেজ বা অজ্ঞান, পানি খুব বেশি আগ্রহ নিয়ে খাওয়া বা একদম পান করতে না পারা। এছাড়া পেটের চামড়া টেনে ধরে ছেড়ে দিলে যদি পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে একটু দেরী হয় তবে এই চিহ্নটি মা-বাবার জন্য বোঝা কঠিন।

যেভাবে বুঝবেন অধিক পানি স্বল্পতা
যদি অবসন্ন, নেতিয়ে পড়া, অজ্ঞান কিংবা ঘুম ঘুম ভাব থাকে, চোখ বেশি বসে যায় এবং শুকনো দেখায়, চোখে পানি না থাকে, মুখ ও জিহ্বা খুব শুকনো থাকে, পানি পান করতেও কষ্ট হয় কিংবা একেবারেই পারে না, পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিলে অত্যন্ত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায় ও শিশুর শরীরে এসবের মধ্যে দুই বা ততোধিক চিহ্ন থাকলে বুঝতে হবে শিশুটি ‘চরম পানি স্বল্পতা’ স্তরে রয়েছে এবং শিশুকে কাছের কোনো হাসপাতালে দ্রুত ভর্তি করতে হবে।

স্যালাইন তৈরি:
বর্তমানে সব এলাকাতেই স্যালাইন পাওয়া যায়। এছাড়া পরিবারে শিশু থাকলে ঐসব পরিবারে কয়েক প্যাকেট স্যালাইন সব সময় রাখা উচিৎ। স্যালাইন তৈরির জন্য ৫০০ মিলি বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে পুরো একপ্যাকেট স্যালাইন গুড়া ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। ৫০০ মিলির জন্য কেনা পানির বোতল ব্যবহার করা যেতে পারে। তৈরির পর ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে।

লেখক:

ডা. সৈয়দা নাফিসা ইসলাম

কনসালটেন্ট, শিশু বিভাগ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে