কিডনি মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা রক্ত থেকে বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে শরীরকে সুস্থ রাখে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিয়মিত জীবনযাপন, অ্যালকোহল সেবন বা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের কারণে কিডনি দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এ অবস্থা রূপ নিতে পারে ক্রনিক কিডনি ডিজিজে (সিকেডি), যা জীবনকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করতে পারে।
বিশ্বজুড়ে গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ দেখা যায় না। ক্লান্তি, চোখ বা গোড়ালিতে ফোলা, প্রস্রাবে পরিবর্তন, ক্ষুধামন্দা, বমিভাব, চুলকানি, পেশি টান, উচ্চ রক্তচাপ বা মনোযোগের অভাব—এসবই রোগের অগ্রগতি বোঝার সাধারণ সংকেত। তাই সময়মতো পরীক্ষা করা এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু পর্যাপ্ত পানি পান করলেই নয়, কিছু প্রাকৃতিক পানীয়ও কিডনির কার্যক্ষমতা উন্নত করে এবং কিডনি রোগের ঝুঁকি কমায়। নিচে এমন পাঁচটি প্রাকৃতিক পানীয়ের কথা উল্লেখ করা হলো, যা নিয়মিত গ্রহণ করলে কিডনিকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখে।
আদা-পুদিনা হারবাল চা
আদা ও পুদিনা একসঙ্গে ফুটিয়ে তৈরি করা চা শুধু হজমে সাহায্যই করে না, বরং মূত্রনালীর স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। আদায় থাকা ‘জিঞ্জেরল’ নামক বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ প্রদাহ ও ব্যথা প্রশমনে সহায়তা করে, যা কিডনির ফোলাভাব কমাতে কার্যকর। অন্যদিকে, পুদিনা মূত্রনালীর জ্বালাপোড়া উপশমে সহায়ক। এই দুই উপাদানের সংমিশ্রণ শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, যা কিডনি রোগের অন্যতম কারণ। এতে রক্তপ্রবাহ উন্নত হয় এবং কিডনির ছাঁকন ক্ষমতা বাড়ে। এক টুকরো লেবু যোগ করলে এতে ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা বেড়ে যায়, যা শরীরের জন্য আরও উপকারী করে তোলে।
গ্রিন টি
গ্রিন টিতে থাকা পলিফেনল নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিডনি কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে কিডনিতে পাথর গঠনের ঝুঁকি কমে এবং কিডনির ছাঁকন ক্ষমতা বাড়ে। এর মধ্যে থাকা ‘ইপিগ্যালোক্যাটেচিন-৩-গ্যালেট (ইজিসিজি)’ নামক যৌগ রক্তে গ্লুকোজের বিষক্রিয়া প্রতিরোধে কার্যকর, যা কিডনিকে সুরক্ষিত রাখে।
এছাড়া, এটি হৃদ্স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং শরীরের তরল ভারসাম্য ঠিক রাখে—যা কিডনির সঠিক কার্যক্রমের জন্য অপরিহার্য। যদিও এতে অল্পমাত্রায় ক্যাফেইন থাকে, তা শক্তি যোগায় কিন্তু কিডনিতে অতিরিক্ত চাপ ফেলে না। তবে পরিমিতভাবে পান করাই শ্রেয়।
ত্রিফলা
ত্রিফলা হলো তিনটি ফল—আমলকি, হরিতকি ও বীভিতকির সংমিশ্রণ, যা প্রাচীন আয়ুর্বেদে কিডনি পরিশোধনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে ভিটামিন সি ও গ্যালিক অ্যাসিডসহ প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়। আধুনিক গবেষণাও এর উপকারিতা নিশ্চিত করেছে। এটি হজমশক্তি বাড়ায়, বিপাকক্রিয়া উন্নত করে এবং শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে—যা কিডনির স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
ত্রিফলা চা হিসেবে পান করা যায় বা খাদ্য পরিপূরক হিসেবেও গ্রহণ করা যেতে পারে। এর প্রাকৃতিক ডিটক্সিফাইং ক্ষমতা কিডনির ছাঁকন প্রক্রিয়া সচল রাখে এবং টক্সিন জমতে দেয় না।
তাজা সেলারি জুস
সেলারি একটি প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক, যা শরীরের অতিরিক্ত তরল ও টক্সিন বের করতে সহায়তা করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিডনিকে প্রদাহ ও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত সেলারি জুস পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কাও অনেক কমে যায়।
‘জার্নাল পিএমআইপিএ’-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেলারি এক্সট্র্যাক্ট প্রোটিনুরিয়া (প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন) কমায় এবং কিডনি স্ট্রেস হ্রাস করে। এক গ্লাস সেলারি জুস তৈরির জন্য কয়েকটি ডাঁটা ব্লেন্ড করে ছেঁকে সকালে খালি পেটে পান করা যেতে পারে। এর সতেজ স্বাদ শরীরকে হাইড্রেট রাখে, যা কিডনির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড্যান্ডেলিয়ন রুট টি
ড্যান্ডেলিয়ন রুট টি শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল ও টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এটি কিডনি ও লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং প্রদাহ কমায়। ‘নিউট্রিয়েন্টস’ জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড্যান্ডেলিয়ন পাতার নির্যাস কিডনি কোষকে প্রদাহজনিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
নিয়মিত এই চা পান করলে শরীরে পানির ভারসাম্য ঠিক থাকে, মূত্র প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং কিডনির কাজ আরও কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয়। যারা পানি জমে থাকা বা কিডনি কার্যক্রম ধীরগতির সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে এক প্রাকৃতিক সহায়ক পানীয়।
পর্যাপ্ত পানি পান করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়
সবশেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—পর্যাপ্ত পানি পান। পানি কিডনিকে রক্ত থেকে বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে এবং শরীরে ক্ষতিকর উপাদান জমতে দেয় না। যথেষ্ট পানি পান করলে কিডনিতে পাথর বা মূত্রনালির সংক্রমণের ঝুঁকিও কমে, যা দীর্ঘমেয়াদে কিডনি সুরক্ষার অন্যতম সহজ উপায়।


